সরকারি চাকরিতে বদলি এক অবশ্যম্ভাবী ঘটনা। বদলি যদি মনে রাখার মতো হয়,তার রেশ জীবন জুড়ে রয়ে যায়। অতীন সেই তিরানব্বই সালের আগস্ট মাসে উত্তরবঙ্গ থেকে বদলি হয়ে চন্দননগর ডিভিশন অফিসে প্রশাসনিক আধিকারিকের পদে যোগ দিল। দক্ষিণ কলকাতার এক প্রত্যন্ত জায়গায় ওর বাস। রোজ বাসে,রেলে চেপে চন্দননগর আসা যাওয়া করতে হত।
চন্দননগর যাওয়ার জন্য প্রথম দিন একটু আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সে। চন্দননগর বিদ্যুৎ পর্ষদের ডিভিশন অফিসে সকাল সকালই পৌঁছে গেল। বড়বাজারে বেশ পুরনো একটি বাড়ির তিনটি তলা জুড়ে ওই অফিস। ও এই অফিসে পি.ও. সাহেব হিসেবে যোগ দেবেন শুনে মাধব রায় নামে এক ধুতি পরা পিওন ওর ঘরটিতে নিয়ে গেল।
–এই স্যার, আপনার চেম্বার। এখানেই আপনি বসবেন।
অতীন দেখল ওর ঘরটি খুবই ছোট, ওর টেবিলের সামনে দুজন বসলে তৃতীয় জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। চেয়ার রাখার আর জায়গাই নেই।
পুরো টেবিল জোড়া ফাইল, কর্মীদের সার্ভিস বই, পুরু ধুলো পড়ে রয়েছে ঘরে, টেবিলে।
–অনেক দিন কোন সাহেব নেই তো, তাই স্যার অমন ধূলো পড়েছে। কুশ, কুশ কোথায় গেলি?সাহেবের টেবিল চেয়ারগুলোর ধুলো ঝেড়ে দে তো।
একজন সরু লিকলিকে মধ্যবয়সী লোক এসে ঘরের ধুলো ঝেড়ে ঘরটি একটু বসবার উপযুক্ত করে তুলল।
একজন দীর্ঘকায় পাজামা পাঞ্জাবী পরা ভদ্রলোক এসে পরিচয় করলেন।
–আমি সুজিত, সুজিত মুখার্জি, এই আপনার ঘরের ঠিক বাইরেই বসি রিসিভ সেকশনে। কোনওরকম অসুবিধা হলে আমাকে বলবেন। আমরা তো স্যার সেই ভড় কোম্পানির আমলের কর্মী। তারপর তো টেক ওভার হয়ে আজ বিদ্যুৎ পর্ষদের এই ডিভিশন অফিসে। কে ভড় কোম্পানি, কীসের টেক ওভার– অতীন তখন কিছুই বোঝে না।
অতীন বুঝল এ এক বিরাট অফিস।তিনটি তলায় মোটামুটি শ’খানেকের বেশি কর্মচারী কাজ করে এই অফিসে, পুরো বাড়িটা যেন কেমন গমগম করছে।
–চলুন স্যার, আপনাকে ডিভিশন ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের চেম্বারে নিয়ে যাই।
অতীন সেই চেম্বারে ঢোকার সময় দেখে বড় বড় হরফে নেমপ্লেট লেখা –পি কে মিত্র, ডিভিশন ইঞ্জিনিয়ার।ওর তো বেশ নার্ভাস লাগছিল।
–স্যার, এই যে আমাদের পি.ও. সাহেব।অতীন দাস।আজ জয়েন করেছেন।
ডি ই সাহেব কয়েকজনের সঙ্গে কিছু আলোচনা করছিলেন। অতীনকে দেখে একটি চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন।
–হেড অফিসের দাস সাহেব বললেন আপনার পোস্টিং এর কথা। এই অফিসের আন্ডারে তেইশটা অফিস আছে বুঝলেন, হুগলি জেলার অনেকটা।এখানে কাজের প্রেশার খুব। কয়েকশো সার্ভিস বই মেইনটেইন করতে হবে।
–হ্যাঁ, স্যার আমি নিশ্চয়ই পারব।
–পারলেই ভালো।অনেকটা সময় দিতে হবে।আপনি তো আবার সেই কলকাতা থেকে আসবেন। দেখা যাক। যান নিজের কাজ বুঝে নিন।
অতীন নিজের কাজ বুঝতে থাকে ধীরে ধীরে। অতীন একদিন নিজের ঘরে কাজ করছে। হঠাৎ একজন ছোট্ট খাট্টো চেহারার ভদ্রলোকের প্রবেশ। চেম্বারে ঢুকেই টেলিফোনটি নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকগুলো কল করলেন। অতীন লক্ষ করল যে, লোকটির কোন কথাই অফিস সংক্রান্ত নয়। কলগুলো অনেক সময় চালিয়ে, তিনি ফোন রাখলেন। এবার অতীনের দিকে তাকিয়ে বললেন,–আমি সমর বন্দোপাধ্যায়,ক্যাশিয়ার গ্রুপ টু।
অতীন তাকিয়ে বলল,–ও আপনি ক্যাশিয়ার? কোথায় বসেন?
–না, আমি কোথাও বসি না। আমি আসলে দিন দশেক হল এই ডিভিশনে বদলি হয়ে এসেছি বিদ্যুৎ ভবন থেকে। আবার আমার ট্রান্সফার অর্ডার হবে। আমি বিদ্যুৎ ভবনে ফিরে যাব।
–ওহ।
–আমার দাদা অমুক বন্দোপাধ্যায়, সাংসদ, চেনেন তো?নাম শোনেননি? মার বৌদি হলেন তমুক বন্দোপাধ্যায় এমএলএ, চেনেন তো?
অতীন ভাবে এই বাম জমানায়, এই ডিভিশনে ডানপন্থী, বামপন্থী মিলে মিশে, রসেবশে বেশ আছে তো।
যেমন কথা তেমন কাজ। ঠিক দশদিনের মাথায় সমরবাবুর অর্ডার এসে গেল বিদ্যুৎ ভবনে বদলির।
এই ডিভিশনের নানারকম কান্ডকারখানার অতীন প্রতিদিনের সাক্ষী। ডি ই সাহেবের চেম্বারে দিনে বেশ কয়েকবার যেতে হয় ওর।
ডি ই সাহেব ওকে নানা ধরনের পরামর্শ দেন।বলেন,
–এটি কিন্তু হুগলি জেলা। অনেক ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে এখানে।
অতীন সেই প্রথম দিন থেকে দেখছে ডি ই সাহেবের চেয়ারের একটু পেছন দিকে একটা পুরোনো আমলের কাঠের গদিসাঁটা চেয়ার, বেশ দেখতে– অনেকটা সিংহাসনের মতন। পিছনে কাঠের ওপর কারুকাজ করা।
তাই একদিন ডি ই সাহেবকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
–স্যার, আপনার পেছনের ওই চেয়ারটা কেন রাখা? ওখানে কি কেউ বসতেন?
–ও ওই চেয়ারটা বোধহয় ব্রিটিশ আমলের, ভড় কোম্পানির চেয়ার ওটা। দেখছেন কেমন সিংহাসনের মতন। ওদের মালিক টালিকরা ওতে বসত মনে হয়।
–হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। কিন্তু আপনি না বসে পিছনে রেখে দিয়েছেন?
–আরে ওই চেয়ারটা যতই দেখতে রাজকীয় হোক না কেন, বসে কিন্তু আরাম নেই। কেমন যেন শক্ত শক্ত। তাই আমি রিভলভিং চেয়ারটা আনিয়েছি।
–তা যাই বলুন, ওই চেয়ারটা দেখতে কিন্তু দারুন।
–সেই জন্যই তো পেছনে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে দিয়েছি। আরে আমার আগেও এক চ্যাটার্জি সাহেব ওতে বসতেন।
অতীন দেখেছে যে কুশ রোজ ওই চেয়ারটা ঝেড়ে মুছে রাখে।
এটি ভড় কোম্পানির আমলের কাঠের চেয়ার, মনে হয় ব্রিটিশ আমলের। আমরা এখনও সাফসুতরো করে রেখেছি।
–এত সুন্দর চেয়ার থাকতে, আগের সাহেবরা বসতেন না কেন?
–আমি তো কতবার সাহেবদের অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু কোন সাহেবই ওতে বসতেন রাজি হননি,কেন কে জানে?
–আরে কুশ,তুমি স্যারের ঘরের সিংহাসনটা রোজ অমন সাফসুতরো করে রাখ? সাহেব তো বসেন না।
–স্যার, বহুদিনের অভ্যাস তো তাই।আমি এই ডিভিশনে আজ কুড়ি বছর পোস্টেড আছি।কত সাহেব দেখলাম। শুধু কোন মিটিং হলে সাহেবের ঘরে চেয়ার কম পড়ে তো, তখন ওই চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসা হয়।তাই সাহেব ওখানেই রাখতে বলে।
এভাবেই দিন কেটে যায়।তবে একবার অতীন ডি ই সাহেব তখন ঘরে ছিলেন না, তখন ওই চেয়ারটায় আরাম করে বসে দেখেছে, বেশ একটা ‘মুই কি হনু রে’ ফিলিং হয় ওই সিংহাসনে বসলে।
মিত্র সাহেব প্রোমোশন পেয়ে বড় অফিসে বদলি হয়ে যান। এবার এলেন বোস সাহেব ডি ই হয়ে। ছোটখাটো চেহারা, নিজেকে জাহির করার দিকে কোন ঝোঁক নেই।
বিদ্যুৎ পর্ষদের অফিস তো, নানারকম পাবলিকের ঝামেলা লেগেই থাকত। কোনরকম ঝামেলা হলে সেখানে বোসসাহেব এমনভাবে যেতেন যেন তিনিও পাবলিকের একজন। কাবুলি জুতো ফটফট করে, ডি ই সাহেব বলে কেউ বুঝতেই পারত না।
একদিন বোস সাহেবকে অতীন সেই চেয়ারের কথাটা পাড়ে।
–স্যার, আপনি তো ওই চেয়ারটায় বসতে পারেন।ওটা একটা ঐতিহাসিক চেয়ার।
–আরে,ওই জন্যই তো বসব না। বুঝলেন, এই সব অফিস অফিস হল চলন্ত গাড়ির মতো, আমরা হলাম তার প্যাসেঞ্জার। এখানে কোন বন্ধনে জড়ালেই বিপদ। চাকরির দিনগুলো প্যাসেঞ্জারের মতো কাটিয়ে কেটে পড়তে পারলে বেঁচে যাই।ও চেয়ার যেখানে যেমন আছে থাকুক। আমার এই রিভলভিং চেয়ারই ভালো।
এভাবেই বোসসাহেবের দিনগুলি কেটে যায়।ওর বদলির পর ডি ই হয়ে এলেন দত্তসাহেব। গৌরবর্ণ, ছ’ফুটের ওপর লম্বা,অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী অফিসার।উনি একদিন অতীনকে ডেকে পাঠালেন।
–আচ্ছা এই পেছনে রাখা চেয়ারটি তো বেশ দেখতে।
–হ্যাঁ, স্যার, এটি ভড় কোম্পানির আমলের কাঠের চেয়ার, মনে হয় ব্রিটিশ আমলের। আমরা এখনও সাফসুতরো করে রেখেছি।
–এত সুন্দর চেয়ার থাকতে, আগের সাহেবরা বসতেন না কেন?
–আমি তো কতবার সাহেবদের অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু কোন সাহেবই ওতে বসতেন রাজি হননি,কেন কে জানে?
দত্ত সাহেব পরদিনই আদেশ দিলেন রিভলভিং চেয়ারটা পিছনে সরিয়ে ওর বসার জন্য যেন সেই সিংহাসনটি রাখা হয়।কুশ তো খুব আনন্দিত। কতদিন পর আবার এক সাহেব ওই চেয়ারে বসবেন।
–হ্যাঁ,সাহবকে মানাবে খুব। যেমন সাহেবের দশাশই চেহারা, তেমন ওই সিংহাসন।
দত্ত সাহেব যেদিন প্রথম চেয়ারটিতে বসলেন, সবার পীড়াপীড়িতে রসগোল্লাও খাইয়ে দিলেন।
যেদিন থেকে আমি এই আসনে বসেছি, আমার ওপর গ্রহের কুপ্রভাব পড়তে শুরু করেছিল।
–স্যার, এ কী বলছেন? ক্যানসার এমন একটি রোগ, এটি কীভাবে কার শরীরে বাসা বাঁধে, কেউই বলতে পারে না।
–না, তা যাই হোক, আমার দুর্ভাগ্যের সূচনা ওই চেয়ারটা বদলের দিন থেকেই হয়েছে।ওই রাতেই আমার মিসেস সেন্সলেস হয়ে যায়।
বেশ চলল বছরখানেক।এরপর দত্তসাহেব একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন ওর স্ত্রীর শরীর নিয়ে।দুটো ছেলে বাইরে পড়াশুনা করে,তাই ম্যাডামের ডাক্তার বদ্যির ব্যবস্থা দত্ত সাহেবকেই করতে হচ্ছিল। অনেক দিনই নিয়মিত অফিসে আসতে পারছিলেন না। যদিও শুরু হয়েছিল হজমের গন্ডগোল দিয়ে কিন্তু ক্রমে ম্যাডামের পেটে ক্যানসার ধরা পড়ল।এর পর যা হয়, সেই মুম্বই-এ টাটা ক্যানসার সেন্টারে নিয়ে যাওয়া, কেমোথেরাপির ব্যবস্থা চলছিল।এই সব ব্যবস্থার জন্য অফিসের ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব নিতে উনি আর পারলেন না। কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলেন অপেক্ষাকৃত কম দায়িত্বের অফিসে যেন ওকে বদলি করা হয়।
এতদিন দত্ত সাহেবের সুখ দুঃখের সঙ্গে এই অফিসের কর্মীরা জড়িয়ে ছিল। এবার সাহেবের বদলির আদেশ হল হুগলি সার্কেল অফিসে, এল সাহেবের বিদায়ের দিন।
যাবার দিনে ওর চেম্বারে বসে একটি ছোট্ট বিদায় অনুষ্ঠান হচ্ছিল। সেই অনুষ্ঠানে উনি একটি এমন অদ্ভুত কথা বললেন যা অতীনকে হতবাক করে দিল।
উনি বললেন,–আপনাদের জানাই আমার ওই পুরোনো রিভলভিং চেয়ারটা ছেড়ে এই সিংহাসনটায় বসা ঠিক হয়নি। যেদিন থেকে আমি এই আসনে বসেছি, আমার ওপর গ্রহের কুপ্রভাব পড়তে শুরু করেছিল।
–স্যার, এ কী বলছেন? ক্যানসার এমন একটি রোগ, এটি কীভাবে কার শরীরে বাসা বাঁধে, কেউই বলতে পারে না।
–না, তা যাই হোক, আমার দুর্ভাগ্যের সূচনা ওই চেয়ারটা বদলের দিন থেকেই হয়েছে।ওই রাতেই আমার মিসেস সেন্সলেস হয়ে যায়।
অফিসের সবাই দত্ত সাহেবের মনের অবস্থা চিন্তা করে আর কথা না বাড়িয়ে ম্যাডামের জন্য শুভ কামনা করে ওঁকে সেদিন ভারাক্রান্ত মনে বিদায় দেয়। যাওয়ার আগে দত্ত সাহেব সিংহাসনটিকে পিছনের সেই পুরোনো জায়গা সরিয়ে একবার আবার রিভলভিং চেয়ারটিতে বসলেন।তারপর বিদায় নিলেন চন্দননগর বিভিন্ন থেকে।
এবার ডিভিশন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এলেন সরকার সাহেব। বারাসাতে বাড়ি। ছটফটে লোক, এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসা পছন্দ করেন না। টেবিল সর্বক্ষণ পরিষ্কার।উনি একদিন অতীনকে ডেকে পাঠালেন।
–আপনি তো এখানে অনেক বছর আছেন।
–হ্যাঁ স্যার, তিন জন ডি ই পার করলাম।
–এই ডিভিশনের কাজকর্মের বিশেষত্ব আমাকে সময়মতো বুঝিয়ে দেবেন। ইউনিয়ন, নেতা আপনিই সামলাবেন। আপনি তো পি ও সাহেব মানে পারসোনেল অফিসার। কোনও জটিলতা দেখা দিলে আমার সঙ্গে আলোচনা করে নেবেন। ঠিক আছে?
–হ্যাঁ স্যার, আসলে আগের ডি ই সাহেবরা তো এরকম বলতেন না। আমি ঠিক সামলে নেব।
–ওহ্, আর একটি কথা, আমার পিছনের এই পুরনো চেয়ারটা এখানে রেখেছেন কেন?
–আসলে ওটি অনেক বছরের পুরোনো, ভড় কোম্পানির আমলের। দত্ত সাহেব কিছুদিন বসেছেন ওটায়। আপনি ও বসলে কুশ ভালো করে পরিষ্কার করে দেবে।
–আরে না না, আমার ঘর থেকে এই সব জঞ্জাল হটান তো। কুশ কে ডাকুন, চেয়ারটা বার করে দিক এই ঘর থেকে।
অতীন আর কথা না বাড়িয়ে কুশকে ডেকে চেয়ারটিকে ডি ই সাহেবের চেম্বারের বাইরের বারান্দায় বের করে রাখল।
এভাবে চলল আরও কিছু দিন। সরকার সাহেব অফিসে সবরকম বিষয়ে অতীনের পরামর্শ মতোই কাজ করেন। অতীনের সঙ্গে ওর বেশ একটা বোঝাপড়া হয়ে গেছে। এদিকে কুশ কিন্তু খুব দুঃখিত ওই এতকালের চেয়ারটাতে বারান্দায় বের করে দেওয়ায়।
অতীন চেম্বারে এসে সেই সিংহাসনে বসল।বসে বেশ একটা অন্যরকম লাগছিল। যদিও ঘরটায় নড়াচড়ার জায়গা আরও কমে গিয়েছে, তবুও এইভাবে চেয়ারটাকে তো বাঁচিয়ে রাখা যাবে। ওটার একটা আ্যন্টিক মূল্য তো আছে।
একদিন সকাল থেকে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। সরকার সাহেব অফিসে পৌঁছে গেছেন। অতীনের একটু অফিসে পৌঁছতে দেরি হল। এসে দেখে বারান্দায় সেই চেয়ারটায় বৃষ্টির জল পড়ছে। ও তাড়াতাড়ি কুশকে ডেকে বলল,–আরে, একটু দেখবে তো। চেয়ারটা ভিজে গেল।এত দিন কত আগলে আগলে রাখতাম।
কুশরা চেয়ারটাকে টেনে অফিসঘরের ভিতরে নিয়ে আসে। সরকার সাহেব দূর থেকে দেখছিলেন ওদের এই টানাটানি। বুঝলেন পি ও সাহেব অতীনের এই চেয়ারটার প্রতি একটা দুর্বলতা রয়েছে। উনি কুশকে নিজের চেম্বারে ডাকলেন। বললেন,– তুমি আর তোমার পি ও সাহেব ওই চেয়ারটাকে খুব ভালবাসো দেখছি।
–হ্যাঁ, স্যার, আমরা আছি তাই এই চেয়ারটা এত বছর ওত সুন্দর অবস্থায় রয়েছে। আমি স্যার, এই বাইশ পঁচিশ বছর ডেইলি এই চেয়ারটা ঝাড়পোছ করি। পি ও সাহেব তো এসেছেন তা আট নয় বছর।পি ও সাহেব তো একবার পালিশও করিয়েছেন।
সরকার সাহেব অতীনদের চেয়ারটির প্রতি কেন এমন টান মনে হয় অনুভব করতে পারেন। কুশ কে কাছে ডেকে বলেন,–শোন কাল সকালে পি ও সাহেব অফিসে আসার আগে ওর চেম্বারে ওর বসার চেয়ারটা সরিয়ে এই চেয়ারটা লাগিয়ে দেবে বুঝেছ। আগে থেকে বললে না না করবে। এখন জানিও না।
–কিন্তু স্যার, ওনার ঘরটা তো খুব ছোট।এই চেয়ারটা বসালে তো নড়াচড়ার জায়গা কমে যাবে।
–বেশি পাকামি কোরোনা তো। কোনও অসুবিধা হবে না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি বলেছি, বুঝেছ?
পরদিন সকালে অফিসে ঢুকেই ওই চেয়ারটা দেখে অতীন তো চমকে ওঠে।কুশকে ডেকে পাঠালো।কুশ পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে এই চেয়ার পরিবর্তন ঘটেছে ডি ই সাহেবের আদেশে।
এরপর অতীন চেম্বারে এসে সেই সিংহাসনে বসল।বসে বেশ একটা অন্যরকম লাগছিল। যদিও ঘরটায় নড়াচড়ার জায়গা আরও কমে গিয়েছে, তবুও এইভাবে চেয়ারটাকে তো বাঁচিয়ে রাখা যাবে। ওটার একটা আ্যন্টিক মূল্য তো আছে।
চন্দননগরের এক বিশেষত্ব হল জগদ্ধাত্রী পুজো। সে-পুজো ঘিরে বিদ্যুৎ কর্মীদের মধ্যে চরম ব্যস্ততা থাকে।এরই মধ্যে কর্মী ইউনিয়নগুলো জগদ্ধাত্রী পুজোর ওভারটাইম কত ঘন্টা দেওয়া হবে, তাই নিয়ে ম্যানেজমেন্ট এর সঙ্গে টানাপোড়েনে জড়িয়ে পড়ে।নানারকম উত্তেজনা, দরকষাকষি চলতে চলতে আবার পরের বছরের পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। সেবার এমনই উত্তেজনাময় দিনে ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ চরমবার্তা দিয়ে গেলেন যে, তাদের কথা মতো ওভারটাইম টাইমের প্রতিশ্রুতি না দেওয়া হয়, তাহলে এই বছর কোন টেকনিকাল কর্মী জগদ্ধাত্রী পুজোয় কাজ করবে না।
এমন পরিস্থিতিতে ইউনিয়নের সঙ্গে বসার সময় ঠিক হল। নেতারা থাকবেন। কিন্তু সেদিন উত্তেজনা ছিল চরমে। অফিসের দোড়গোড়ায় মাইক লাগিয়ে স্লোগান, চিৎকার চলছিল। একটু পরেই ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ সরকার সাহেবের চেম্বারে প্রবেশ করবেন। অতীন সারাক্ষণ সরকার সাহেবের সঙ্গেই রইল।
সেদিন সত্যিই ইউনিয়ন মিটিংএ পরিচিত মুখগুলো কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করতে লাগল। সরকার সাহেব নতুন বলে ওঁকে একটু রগড়ে দেওয়া আর কী।পুরো ওভারটাইমের সমস্যাগুলো অতীনই সামলে নিল। ও এই ডিভিশনের কাজকর্মের মধ্যে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে নিজেকে কিছুতেই আলাদা ভাবতে পারে না। তার ওপর এই চন্দননগর শহরটিরও যেন প্রেমে পড়ে গেছে। কলকাতা থেকে এই যে রোজ রোজ এই অফিসে আসা, কোনোদিন এই সফর ওর কষ্টকর মনে হয় নি।
এইভাবে চললো আরও কিছু দিন। এবার অতীনের বদলির আদেশ এল হেড অফিস থেকে। চলে যাওয়ার দিনও এগিয়ে আসতে লাগল। যত সেই দিন এগিয়ে আসতে লাগল তত অতীন ওই চেয়ারটির ওম অনুভব করতে লাগল, এ যেন গভীর এক টান।
পরমুহূর্তেই আবার মনে পড়ল সেই বোস সাহেবের উক্তি,–‘বুঝলেন,এই সব অফিস হল চলন্ত গাড়ির মতো, আমরা হলাম তার প্যাসেঞ্জার।এখানে কোন বন্ধনে জড়ালেই বিপদ।’
সত্যিই সুন্দর এক দর্শন। চেয়ার তো নিজের জায়গায় পড়ে থাকবেই। মানুষের মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। নতুন মানুষ এসে সে চেয়ারের অধিকারী হবেন। অতীনকে তাই চলন্ত গাড়ির প্যাসেঞ্জারের মতন নিজের গন্তব্যে নেমে যেতে হবে।